শামস শামীম, হাওরাঞ্চল ঘুরে ::
‘শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও’ এটি হাওরাঞ্চলের চিরায়ত প্রবাদ। ভৌগোলিকভাবে যোগাযোগ বিড়ম্বিত জলাভূমি হাওর জাতীয় উন্নয়ন-সমতা থেকে নানাভাবে পিছিয়ে আছে।
প্রতি বছর হাওরের অসংখ্য শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। তাই অস্বাভাবিক শিশু মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। স্থায়ী হচ্ছে শোকের মাতম। এই অবস্থায় সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় জেলার তিনটি হাওর উপজেলার শিশুদের মাচায় সাঁতার শেখাচ্ছে। চলতি বছর প্রায় ১১ হাজার ৫০০শ শিশুকের সাঁতার শেখানোর কাজ বাবস্তবায়ন হচ্ছে। এর আগের বছর শেখানো হয়েছে আরো ১১ হাজার শিশুকে।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, সাঁতার শেখার পাশাপাশি কিভাবে একটি শিশু আরেকটি শিশুকে পানিতে ডুবে গেলে উদ্ধার করবে, আগুন লাগলে নিজেকে রক্ষা করবে - এসব শিখিয়ে শিশুদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। একই সঙ্গে হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শেখানো এবং প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে শিশু যত্ন কেন্দ্রে। হাওরের শিশু মৃত্যু রোধে নেওয়া এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ, সুরক্ষা ও শেখার সাচ্ছন্দ্য পরিবেশ নিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুনামগঞ্জ জেলা শিশু একাডেমি ও মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থা (আউস) সূত্রে জানা গেছে, জেলার শান্তিগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুর উপজেলায় মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে ‘সমন্বিত সমাজভিত্তিক শিশু যত্ন, সুরক্ষা এবং সাঁতার নিরাপত্তা কেন্দ্র’ (ইন্টগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার প্রটেকশন এন্ড সুইম সেইফ-আইসিবিসি)। তিনটি উপজেলায় ৫০টি সাঁতার শিখন কেন্দ্র ও দক্ষতা শিখানোর জন্য আরো প্রায় ৫০০টি কেন্দ্র রয়েছে। ছেলে শিশুদের জন্য আলাদা পুরুষ সাঁতার প্রশিক্ষক এবং কন্যা শিশুদের জন্য নারী সাঁতার প্রশিক্ষক সপ্তাহে ৬ দিন মাচার ভিতরে শিশুদের ২১ দিনে সাঁতার শিখিয়ে দিচ্ছেন। সাঁতারের সঙ্গে ২১দিনে ২১টি দক্ষতাও শিখানো হচ্ছে শিশুদের। এছাড়াও শিশু যত্ন কেন্দ্রে ১-৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রে দুইজন ‘গিভার কেয়ার’ মায়ের স্নেহ শিশুদের যত্ন করছেন। অভিনয় করে তাদেরকে ছড়া, গল্প শুনানোর সঙ্গে শিখানো হচ্ছে শৃঙ্খলার শপথ। শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও হাত ধোয়াসহ প্রায়োগিক নানা দক্ষতা বিষয়ক কাজ। কিভাবে আগুন লাগলে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে সেটাও অভিনয়ের মাধ্যমে শিখিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষকরা। এর আগে দায়িত্বরতদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়েছে বলে জানান প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন বৃহস্পতিবার ১১ সেপ্টেম্বর শান্তিগঞ্জ উপজেলার বোগলাখাড়া-নোয়াখালি সাঁতার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা একটি পুকুরে বাঁশ দিয়ে দুটো মাচা তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম মাচার ভিতরে পুরুষ সাঁতার প্রশিক্ষক ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শিখাচ্ছেন। সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছেন সাঁতার সুপারভাইজার কুলসুম বেগম। পানিতে ডুবে গেলে একটি শিশু আরেকটি শিশুকে কিভাবে রক্ষা করবে তা অভিনয় করে দেখাচ্ছিল আরো দুই শিশু। সপ্তাহে ৬ দিন সকাল বিকাল পুরুষ ও নারী সাঁতার প্রশিক্ষক দুটি ব্যাচে ২৫ জন করে ছেলে ও মেয়ে শিশুদের এই পুকুরে সাঁতার শিখান। এখান থেকে নোয়াখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরনো ভবনে গিয়ে দেখা যায় শিশু যত্ন কেন্দ্রে ১-৫ বছর বয়সী শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছেন সায়েরা আক্তার জান্নাত নামের এক শিক্ষিকা। তিনি অভিনয়ের ঢঙে শিশুদের ছড়া শিখাচ্ছিলেন। কিভাবে আগুন লাগলে একজন শিশু দৌড়াদৌড়ি না করে নিজেকে রক্ষা করবে অভিনয় করে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। কেন্দ্রটিতে প্রাক প্রাথমিকের নানা উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল যার প্রায়োগিক ব্যবহার করে আনন্দের সঙ্গে শিখছে শিশুরা। শিশুদের জন্য এখানে আপন ভুবন, রঙের ভুবন, গল্পের ভুবন, স্বপ্নের ভুবনসহ চারটি ভুবন রয়েছে।
জেলার তিনটি উপজেলার এরকম ৫০০টি শিশু যত্ন কেন্দ্রে ১২ হাজার ৫০০ শিশু সেবা ও সুরক্ষা পাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাওরের মায়েরা সাংসারিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তখনই তাদের অজান্তে শিশুরা পানিতে খেলতে এসে ডুবে মারা যায়। মায়েদের কাজের সুবিধার্থে ও শিশুদের সুরক্ষায় এই শিশু যত্ন কেন্দ্রে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মায়ের মমতায় গিভার কেয়াররা শিশুদের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি দক্ষতার শিক্ষাও দিচ্ছেন। শৈশবের প্রারম্ভিক বিকাশে এই প্রায়োগিক দক্ষতা আগামীতে শিশুদের বিশেষ কাজ দিবে বলে মনে করা হচ্ছে।
একই উপজেলার নয়গর সাঁতার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় নারী সাঁতার প্রশিক্ষক কন্যা শিশুদের মাচার ভিতর সাঁতার শিখাচ্ছেন। সাঁতার শিখানোর আগে অভিনয়ের ছলে প্রাথমিক দক্ষতা শিখিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তিনি জানালেন, প্রথম মাচা শেষে দ্বিতীয় মাচায় সাঁতার শেখানো হয়। ১৬-২১ দিনের মধ্যেই দ্বিতীয় মাচায় সাঁতার শেখানোর কাজ শেষ হয়ে যায়। শিশুরা শিখে নেয় জীবন রক্ষার জরুরি অনুষঙ্গ সাঁতার।
এখানে সাঁতার শিখতে আসা দীপ্ত দাস বলেন, ‘আমি আগে সাঁতার জানতাম না। এখানে এসে সাঁতার শিখে ফেলছি। এখন পানিতে ভেসে থাকতে পারি। আমার বন্ধুরাও সাঁতার শিখে ফেলেছে। আমার আর ভয় নাই।’
শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাঁতার সুপারভাইজার কুলসুমা বেগম বলেন, আমাদের উপজেলায় ৫০টি শিশুদের সাঁতার শিখার মাচা রয়েছে। মেয়ে ও ছেলে শিশুদের অভিভাবকরা সন্তানদের সাঁতার শিখিয়ে দেওয়ায় খুশি। সাঁতারের সঙ্গে শিশুরা শিশু যত্ন কেন্দ্রে এসেও দক্ষতা শিখতে পারছে। যা তাদের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার জ্ঞান দিচ্ছে। এই কার্যক্রম শুরু হওয়ায় আমাদের এলাকায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমছে।
নোয়াখালি শিশু যত্ন কেন্দ্রের শিক্ষিকা সায়েরা আক্তার জান্নাত বলেন, আমার কেন্দ্রে ২৫ জন শিশু আছে। কিভাবে তাদের খাওয়া-দাওয়া করতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে সে সম্পর্কে দক্ষতা জ্ঞান দিচ্ছি আমরা। তারাও আনন্দের সঙ্গে শিখছে। এতে মায়েরাও খুশি। তারা শিশু যত্ন কেন্দ্রে দিয়ে নির্ভয়ে দুপুরে সাংসারিক কাজও করতে পারছেন।
সরকারি এই প্রকল্প মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নকারী সংগঠন আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থা (আউস) এর নির্বাহী পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, দুই বছরের এই প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে। দুর্গম হাওর উপজেলার সব উপজেলায় এটি বাস্তবায়িত হলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমতো। কিন্তু আমার তিনটি উপজেলায় বাস্তবায়ন করছি। এখন ওই তিন উপজেলা পানিতে শিশু মৃত্যুহার কমছে।
সুনামগঞ্জ জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা বাদল চন্দ্র বর্মণ বলেন, সারাদেশের ১৬টি জেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের তিনটি উপজেলা রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে শিশুরা সকাল ৯টায় নির্ভয়ে আসে। আমাদের শিক্ষকরা মায়ের মমতায় শেখান। শিশুরা দক্ষতা শিখে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনের শিক্ষা নিচ্ছে। বিশেষ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ায় হাওরে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমছে। তিনি আরো বলেন, শিশু যত্ন কেন্দ্রে চারটি ভুবনের ধারণা দেন। প্রাকৃতিকভাবে দুর্গম এই জেলার জন্য এই প্রকল্পটি জরুরি। শিশুরা উপকৃত হচ্ছে। শিশু মৃত্যু কমছে। এটা হাওরের প্রতিটি উপজেলায় বাস্তবায়িত হলে হাওরের শিশুদের মৃত্যুহার কমবে এবং তারা দক্ষ হিসেবেও গড়ে ওঠবে বলে জানান তিনি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
আপন ভুবনে রূপ নিয়েছে শিশু যত্ন কেন্দ্র
দুর্গম হাওরের ২২ হাজার শিশুকে সাঁতার শিখাচ্ছে সরকার
- আপলোড সময় : ১৪-০৯-২০২৫ ০৯:৪৮:৫৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-০৯-২০২৫ ১০:০০:৪১ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ